ক্ষুদ্রঋন, জাতিসংঘ মহাসচিব এবং নাম না-জানা বগুড়ার গ্রামের গৃহবধুর কথা

অনেকের হয়ত মনে পড়তে পারে, গতবছরের শেষের দিকে, নভেম্বরে, জাতিসংঘের মহাসচিব বান-কি-মুন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ সফরের এক পর্যায়ে তিনি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় গিয়েছিলেন, গ্রামীন ব্যাংক কি করে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীন নারীদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে তা দেখার জন্য। নিজে পরিদর্শন করে দারিদ্র বিমোচন, উন্নয়ন, ভাগ্য পরিবর্তন ইত্যাদি অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন এবং আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন।

এর কদিন আগে, ঐখানেরই কোন এক ঋণ গ্রহিতা, নাম না জানা গৃহবধু স্থানীয় এনজিওর এর আফিসে যেয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কেউ ঋন নেয়ার পর মারা গেলে কি হয়?’ তাকে জানানো হয়েছিল, ‘লোন নিয়ে কেউ মারা গেলে লোন মাফ করে দেয়া হয়’।

সেদিন (বা পরদিন রাতে) সেই গৃহবধু আত্মহত্যা করে, বাকি ঋন শোধের দায় থেকে মুক্তির জন্য। এটি সম্ভবত মহাসচিব বান-কি-মুন এর নারীদের ভাগ্য পরিবর্তন পরিদর্শন এর দুই/এক দিন আগের ঘটনা।

ঘটনা এতটুকুই এবং এটি হয়ত একটি বিচ্ছিন্ন কাকতালীয় ঘটনা। এই ঘটনার সেই গৃহবধু ছাড়া, বাংলাদেশের অন্যান্য সব গৃহবধুরা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে ফেলেছেন, ফেলছেন এবং ফেলবেন। এবং তা বেচে এনজিও কর্মীরা মাসে মাসে বেতন নিয়েছেন, নিচ্ছেন এবং নিবেন। তারপরেও কেন জানি মাঝে মাঝেই এই নাম না জানা গ্রামের বধুর কথা মনে পড়ে।

বোঝার চেষ্টা করি, এরকম একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে মানুষকে কতটা চাপে পড়তে হয়? যে স্বপ্ন দেখে তিনি ঋন নিয়েছিলেন এবং আত্মহত্যার আগের বাস্তবতার মধ্যে কতটুকু ফারাক তিনি দেখেছিলেন? আত্মহত্যার আগের দীর্ঘ নির্ঘুম রাতে তার মাথায় কি স্বপ্ন কি চিন্তা খেলা করছিল? গোয়ালে দুধেল একটা গরু, মাচানে সবুজ লাউ, উঠানে প্যাঁক প্যাঁক করা একদল হাঁস, দড়িতে শুকাতে দেয়া পিত রং এর ভেজা শাড়ি, বাতাসে ঢেউ খেলা সোনা রং এর ফসলের ক্ষেত বা কাদা মাখা ছোট বাচ্চাটার মুখ? নাকি ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’ লেখা এক বান্ডিল নীল একশ টাকার নোট? কে জানে!

মাঝে মাঝে ভাবি (একান্ত ব্যাক্তিগত মতামত) , সমাজের সবচেয়ে ধূর্ত একদল লোক দায়িত্ব নিয়েছে, সমাজের সবচেয়ে সরল লোকগুলোর ভাগ্যউন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের। ট্রাজেডি এটাই।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *